মধ্যাকর্ষণ শক্তির কথা আসলেই সবার আগে যে নামটি মনে পড়ে, তিনি হলেন স্যার আইজ্যাক নিউটন। শিক্ষিত মানুষ মাত্রই আইজ্যাক নিউটনের নাম শুনেছে। তিনি একাধারে পদার্থবিদ, রসায়নবিদ, দার্শনিক, জ্যোতির্বিদ, ধর্মতত্ত্ববিদ, গণিতবিদ ও অর্থনীতিবিদ ছিলেন! নিউটনের জীবনকাহিনী খুবই ঘটনাবহুল, অদ্ভুত এবং রহস্যময়। এই মহান বিজ্ঞানীর জীবনের কিছু মজার গল্প তুলে ধরছি পাঠকদের উদ্দেশ্যে।
* স্যার আইজ্যাক নিউটনের জন্মতারিখ নিয়ে একটা মজার কনফিউশন আছে। তার জন্মতারিখ গণনা করা হয় ৪ই জানুয়ারি ১৬৪৩ সালে। তিনি জন্মেছিলেন বড়দিনে। কিন্তু, বড়দিন তো ২৫ ডিসেম্বর। তাহলে! রহস্যটা হলো, তার জন্মের সময় (১৬৪৩ সালে) ইংল্যান্ডে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে সাল গণনা করা হতো। তখনো গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু হয়নি। জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে নিউটনের জন্ম ২৫ ডিসেম্বর। যখন থেকে (১৭৫২ সাল) ইংল্যান্ডে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু হয়, তখন থেকে এর সাথে মিলিয়ে ১১ দিন পিছিয়ে নিউটনের জন্মতারিখের হিসেব করা হয় ৪ জানুয়ারি।
* নির্দিষ্ট সময়ের ১০-১২ সপ্তাহ আগে জন্মেছিলেন বলে নিউটন জন্মের সময় খুব দুর্বল ও শীর্ণকায় ছিলেন। তিনি বাঁচবেন, সেটাই ছিল দুরূহ আশা। তিনি জন্মের সময় কতটা ছোট ছিলেন, এ বর্ণনা দিতে গিয়ে তাঁর মা বলেছিলেন, এক কোয়ার্টার কাপের মধ্যে নিউটনকে রাখা যেত! সৃষ্টিকর্তার তাকে নিয়ে অনেক বড় পরিকল্পনা ছিল বলেই হয়তো সে যাত্রায় তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন।
* মজার ব্যাপার হলো, আইজ্যাক নিউটনের বাবার নামও ছিল আইজ্যাক নিউটন!
* নিউটন ব্যক্তিজীবনে খুব নিঃসঙ্গ ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তিনি সহজেই মানুষের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তেন। কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, তিনি অটিস্টিক ছিলেন অথবা তার মধ্যে দ্বৈত সত্ত্বা (Bipolar Disorder) কাজ করতো। কোনটি নিশ্চিতভাবে সত্য, সেটি জানার তো আর অবকাশ নেই!
* নিউটন তোতলা ছিলেন। কথা বলার সময় তিনি আটকে যেতেন। বিখ্যাত মানুষদের মধ্যে এ্যারিস্টোটল, উইনস্টন চার্চিল, চার্লস ডারউইন প্রমুখ ব্যক্তিবর্গেরও এই সমস্যা ছিল।ভীষণ বদমেজাজী আর জেদী ছিলেন আইজ্যাক নিউটন। তিনি নিজের সব কাজের তালিকা তৈরি করতে পছন্দ করতেন। তার তৈরি একটি তালিকায় ১৯ বছর পর্যন্ত করা ৪৮টি অপরাধের স্বীকারোক্তি ছিল। এর তালিকায় ছিল তার মা এবং সৎ বাবাকে বাড়িসহ জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার হুমকি, বোনকে ঘুষি মারা, মা ও বোনের সাথে খিটিমিটি, এরকম আরও অনেক কিছু্!
* স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন নিউটন ছাত্র হিসেবে খুবই অমনোযোগী ছিলেন। কিন্তু সে সময়ে তিনি একটি সূর্যঘড়ি, পানি দ্বারা চালিত একটি ঘড়ি, যান্ত্রিক ঘোড়ার গাড়ি, এমন আরও অনেক কিছু তৈরি করেছিলেন যেগুলো ছিল তার প্রতিভার প্রথম প্রকাশ।
* কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় নিউটন সাইজার (Sizer) এবং ওয়েটার হিসেবে কাজ করতেন। সাইজার বলতে সেইসব ছাত্রদের বোঝায় যারা অন্য ছাত্রদের ফুটফরমায়েশ খাটার বিনিময়ে সামান্য কিছু আর্থিক সাহায্য পেয়ে থাকে।
* নিউটনের মাথায় আপেল পড়ার যে ঘটনাটি বহুলভাবে প্রচলিত আছে সেরকম কোনো ঘটনা কখনো ঘটেইনি বলে ইতিহাসবিদদের ধারণা। অন্ততপক্ষে, যেভাবে ঘটনাটি প্রচলিত আছে সেভাবে তো নয়ই। নিউটনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, তিনি যখন লাইব্রেরির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন, তখন একটি গাছ থেকে আপেল পড়তে দেখে মধ্যাকর্ষণের চিন্তা তাঁর মাথায় আসে।
* নিউটনের ল্যাবরেটরিতে একবার আগুন লেগে তার ২০ বছরের গবেষণার কাজ নষ্ট হয়ে যায়। আগুন লাগার কারণ হিসেবে তিনি তার পোষা কুকুরকে দায়ী করেন। কিন্তু, বাস্তবে তার পোষা কুকুর ছিল এরকম কোন প্রমাণ ইতিহাসবিদরা পাননি। তাদের ধারণা ল্যাবরেটরির খোলা জানালা দিয়ে আসা দমকা বাতাসে মোমবাতি উল্টে সেখানে আগুন লেগে থাকতে পারে, নিউটনের কখনোই কোন কুকুর ছিল না। তারপরও কুকুরের কাহিনীটিই যুগ যুগ ধরে মানুষের মুখে মুখে রয়ে গেছে।* জীবনের একপর্যায়ে নিউটন রাজনীতিক হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেন। তিনি ১৬৮৯ সালে এক বছরের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিজ্ঞানী হিসেবে পৃথিবী জোড়া সুখ্যাতি অর্জন করলেও রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি খুব একটা ভাল ছিলেন না। প্রচলিত আছে, তিনি এক বছর পার্লামেন্টের সদস্য থাকাকালে মাত্র একবার কথা বলেছিলেন। সেটিও আবার একজনকে স্রেফ জানালা লাগানোর জন্য!
* নিউটন অবিবাহিত ছিলেন। তিনি চিরকুমার ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। কোন নারীর সাথে তার প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল এরকম কোন প্রমাণও কখনও পাওয়া যায়নি।
* বিজ্ঞানী হয়েও তিনি ছিলেন ধর্মানুরাগী। তার মতে,আবার ধর্মানুরাগী হয়েও নিউটন গোঁড়া ছিলেন না। তিনি বাইবেলের গ্রন্থগত ভুলের সমালোচনা করে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। শুধুমাত্র, বাইবেল ভালোমত বোঝার জন্য তিনি হিব্রু ভাষা শিখেছিলেন। তিনি তার জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় বিজ্ঞানচর্চা বাদ দিয়ে বাইবেলের মর্মার্থ খুঁজে বের করার কাজে ব্যয় করেন। অদ্ভুত হলো, খুব ধার্মিক হওয়া সত্ত্বেও তিনি ভূত, প্রেতাত্মা, শয়তান এসবে বিশ্বাস করতেন না।
* জীবনের শেষভাগে এসে নিউটন দু’বার মানসিক ব্যধিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং তার অদ্ভুত আচরণের কারণে সাড়া ফেলেছিলেন। মানসিক অসুস্থতার জন্য তিনি নিজে তার ঘুমের অভাবকে দায়ী করেছিলেন। কিন্তু ইতিহাসবিদদের ধারণা, অ্যালকেমি চর্চার কারণে রাসায়নিক বিষক্রিয়া এবং দীর্ঘকালীন বিষণ্ণতা তার অসুস্থতার কারণ ছিল।
* নিউটন মারা গিয়েছিলেন ১৭২৭ সালের ২০ মার্চ যেটা বর্তমানে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে গণনা করা হয় ৩১ মার্চ। তাকে সমাধিস্থ করা হয় ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাবেতে। তিনিই প্রথম বিজ্ঞানী যাকে এই সন্মানে ভূষিত করা হয়।
* তাঁর মৃত্যুর প্রায় এক শতাব্দী পর ১৮১৬সালে তার একটি দাঁত নিলামে বিক্রি হয় ৩৬০০ ডলারে। আজকের দুনিয়ায় যার মূল্যমান হত ৩৫০০০ ডলার। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে এটিই এ পর্যন্ত পৃথিবীতে সবচেয়ে দামী দাঁত!
বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের বৈজ্ঞানিক অর্জন ও সফলতার গল্প সর্বজনবিদিত। এখানে তার ব্যক্তি জীবনের যেসব ঘটনা তুলে ধরা হলো, সেগুলোও হয়তো অনেকেরই জানা। তারপরও এরকম মহান মানুষদের জীবন নিয়ে আলোচনা সবসময়ই আনন্দদায়ক!

* নিউটন সম্পর্কে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় সম্ভবত এটি- Alchemy বা অপরসায়ন শাস্ত্রের প্রতি তার ভীষণ অনুরাগ ছিল! বিভিন্ন ধাতুকে কি করে সোনায় রুপান্তর করা যায়, তা এ শাস্ত্রের আলোচ্য বিষয়। নিউটন এ বিষয়ে ১৬৯টি বই লিখেছিলেন। কিন্তু তার জীবদ্দশায় এর কোনোটিই প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। কেননা, সে সময়ের আইন অনুযায়ী সোনা ও রুপা তৈরি করা গুরুতর অপরাধ বলে গণ্য হতো। নিউটনের জীবনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল পরশ পাথর বা Philosopher’s Stone এর সন্ধান করা, যেটা দ্বারা সব ধাতুকে সোনায় রুপান্তরিত করা যাবে।
- * নিউটন ইংল্যান্ডের রাজকোষাগারের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। সেসময় তিনি ব্রিটিশ পাউন্ডের মানদন্ড হিসেবে রুপার পরিবর্তে সোনা ব্যবহারের প্রচলন করেন, যেটা পৃথিবীতে মুদ্রার ইতিহাসে আমূল পরিবর্তন বয়ে আনে।
No comments:
Post a Comment